জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকী কাছাকাছি আসার সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতি এখন অনেকটাই নির্বাচনী মোডে (আমেজ) প্রবেশ করেছে। বর্তমান বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি আগামী নির্বাচনে নিরঙ্কুশ না হলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে—এমনটাই অনেকের ধারণা। নির্বাচনে এমন বিজয়ের ভিত্তিতে দলটি এককভাবে একটি সাংবিধানিক সংস্কার প্যাকেজ আনার দাবি করতেও পারে।
তবে এখানে একটি বড় সতর্কতার জায়গা রয়েছে, সংস্কার প্রশ্নে বিএনপির বর্তমান অবস্থান জামায়াতকে অপ্রত্যাশিতভাবে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী করে তুলতে পারে, যা দলটির নিজের জন্যও অস্বস্তিকর। বিপরীতে কিছু কৌশলগত নমনীয়তা বিএনপির জন্য যেমন বাস্তববাদী রাজনীতি হতে পারে, তেমনি দেশের গণতন্ত্রের জন্যও তা হতে পারে ইতিবাচক।
আসুন, যুক্তিটি একটু খোলসা করে দেখি। ধরা যাক, বিএনপি সাংবিধানিক সংস্কারের মূল প্রস্তাবগুলোকে (যেমন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি অনুপাতভিত্তিক–ভোটভিত্তিক নির্বাচিত উচ্চকক্ষ, যা সংবিধান সংশোধনে ভূমিকা রাখতে পারবে এবং সাংবিধানিক ও জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্বের বাইরে রাখার ব্যবস্থা থাকবে) সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে এবং এমন একটি উচ্চকক্ষের পক্ষে অবস্থান নেয়, যার আসনবিন্যাস নিম্নকক্ষের মতোই।
এ অবস্থান অন্য প্রধান দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়। তখন তাদের সামনে দুটি পথ খোলা থাকবে—এক. তারা বিএনপির অবস্থান মেনে নেবে; দুই. তারা জুলাই চার্টারে সই করবে না, এমনকি নির্বাচন বর্জন করবে।
প্রথমটি কম প্রত্যাশিত। বিশেষ করে এনসিপির ক্ষেত্রে। কারণ, সংস্কার ছাড়া তারা নির্বাচন করবে—এমন কোনো বাস্তব প্রণোদনা নেই। এনসিপি যদি নিজেকে জুলাই বিপ্লবের প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরতে চায়, তাহলে বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন ছাড়া তারা কিছুতেই রাজি হবে না। বরং তারা একটি সর্বোচ্চ সংস্কার এজেন্ডাকেই সফল কৌশল হিসেবে দেখবে, তা তাৎক্ষণিক হোক কিংবা ভবিষ্যতের জন্য।
এখানেই পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে। এনসিপি সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী নয়; ফলে এককভাবে জাতীয় পর্যায়ে তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলতে পারবে না। কিছু ডান ও বাম দলের সমর্থন পেলেও তাদের ‘স্ট্রিট পাওয়ার’ যথেষ্ট নয়। তবে যদি জামায়াতের সমর্থন তাদের সঙ্গে যোগ হয়, তাহলে চিত্রটি বদলে যেতে পারে।
জামায়াত কী করবে
জামায়াত যদি রাজপথে নামে, তাহলে একটি ‘সংস্কারপন্থী’ বনাম ‘সংস্কারবিরোধী’ দ্বন্দ্ব তৈরি হবে। সেখানে জামায়াত হবে নিয়ামক শক্তি এবং এই ভূমিকার মধ্য দিয়ে দলটি জাতীয় রাজনীতিতে নতুন বৈধতা ও মর্যাদা অর্জন করতে পারে। বিকল্পভাবে জামায়াত সংঘর্ষ এড়িয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। এমনকি তারা বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা রেখে জুলাই চার্টারসহ একটি সংস্কারের পথরেখা তৈরিতে সহযোগিতা করতে পারে। এটি তাদের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়িয়ে তুলবে।
এ অর্থে বিএনপি যদি সংস্কার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে যে তিনটি সম্ভাব্য ফলাফল দাঁড়ায়, তার কোনোটিই বিএনপির জন্য শুভ হবে না। প্রতিটি ক্ষেত্রেই জামায়াতই লাভবান হবে।
প্রথমত, জামায়াতের নেতৃত্বাধীন একটি সংস্কারমুখী আন্দোলন নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরকেই ব্যাহত করতে পারে। দ্বিতীয়ত, যদি বিএনপি ছাড়া কেবল ছোট দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেয়, তাহলে সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে। তখন রাজপথে নতুন আন্দোলনের জন্য সুযোগ সৃষ্টি হবে, সেটা হোক জামায়াত অথবা এনসিপির নেতৃত্বে।
তৃতীয়ত, সম্ভবত সবচেয়ে প্রত্যাশিত, জামায়াত নির্বাচনে অংশ নেবে; হয়তো বিএনপিকে কিছু সংস্কারে রাজি করিয়ে, না হয় নিজে থেকেই। এ ক্ষেত্রে বিএনপি নিজেই ভবিষ্যতের প্রধান বিরোধী দলকে শক্তিশালী করে তুলবে, যা ২০৩০-৩১ সাল নাগাদ বড় চ্যালেঞ্জে পরিণত হতে পারে। এ পরিস্থিতিতেও বিএনপির বিরুদ্ধে ‘সংস্কারবিরোধী’ তকমা লেগে থাকবে।
এই তিন পথই ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই বিএনপিকে দুর্বল করে ফেলার ঝুঁকি রাখে। অথচ একটি সহজ সমাধান বিএনপির সামনে খোলা আছে। সংবিধান সংশোধনের জন্য দ্বৈত সংখ্যাগরিষ্ঠতার শর্ত, স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ না রেখে নিরপেক্ষ উচ্চকক্ষ এবং নারীদের জন্য সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা—এই তিনটি মূল সংস্কার যদি বিএনপি গ্রহণ করে, তাহলে তারা এক ঢিলে দুই পাখি মারতে পারবে।
একদিকে তাদের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে কেউ আর ‘সংস্কারবিরোধী’ বলে অভিযোগ তুলতে পারবে না। অন্যদিকে তারেক রহমান নিজেকে ‘সংস্কার-নায়ক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন, প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার (যিনি সংসদীয় পদ্ধতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়েছিলেন) এবং রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের (যিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করেছিলেন) উত্তরসূরি হিসেবে।
বাস্তব দিক দিয়ে দেখলে বিএনপির তেমন কিছু হারানোর নেই। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব–ব্যবস্থাতেও বিএনপি ভবিষ্যতে উচ্চকক্ষে বড় দল হিসেবে থাকবে। যদি দলটি নির্বাচন কমিশনকে হাতের মুঠোয় আনতে না চায়, তাহলে এই ব্যবস্থাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বরং সরাসরি নির্বাচিত নারী সংসদ সদস্যের ক্ষেত্রেও বিএনপির ভালো ফল করার সম্ভাবনাই বেশি।
এই মুহূর্তে জনগণের মধ্যে সাংবিধানিক সংস্কার নিয়ে জাগরণ তৈরি হয়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতার ভারসাম্য, স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা এবং নারীর রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব—এসব প্রশ্ন এখন শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত আলোচিত। বিএনপি যদি জনগণের এই চেতনার সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত না করে, তাহলে ‘প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যাবে।
এর সঙ্গে আছে আন্তর্জাতিক চাপ। জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে বিদেশি কূটনৈতিক মিশনগুলোর নজর আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি শুধু কূটনীতিকদের নয়, অর্থনৈতিক অংশীদারদের কাছ থেকেও আসছে। বিএনপি যদি একক সংস্কারবিরোধী অবস্থানে যায়, তাহলে আন্তর্জাতিক বৈধতা পাওয়াও কঠিন হবে।
জামায়াতের অতীত নিয়ে জাতীয় পরিসরে এখনো যথেষ্ট অনাস্থা রয়েছে। তাদের অংশগ্রহণ কিংবা উত্থান যদি বিএনপির সংস্কার বিরোধিতার ফাঁক গলে ঘটে, তাহলে তা বিএনপির জন্য রাজনৈতিকভাবে বিপর্যয়কর হতে পারে, বিশেষ করে তরুণ ও মধ্যপন্থী ভোটারদের কাছে।
ধরা যাক, বিএনপি সংস্কার না করে সরকার গঠন করল। তাহলে ২০২৮-৩০ সালের মধ্যে একটি সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবার মাথাচাড়া দিতে পারে, যেখানে একটি দুর্বল গণভিত্তির সরকার একদিকে, আর জামায়াত বা এনসিপির নেতৃত্বে রাজপথে নতুন আন্দোলনকারীরা অন্যদিকে। এই চক্রাকার অস্থিরতা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করে তুলবে। এমনকি ‘নিষিদ্ধ’ আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে আনার পথও তৈরি হয়ে যেতে পারে।
সব মিলিয়ে যে পথটি এখনো বিএনপি নেয়নি, সেই পথই হতে পারে তাদের সবচেয়ে কৌশলী ও গণতন্ত্রবান্ধব পথ। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় বিএনপিকে একচেটিয়াভাবে সংস্কারবিরোধী দেখানো হচ্ছে, তা বাস্তবে কতটুকু সত্যি?
মূল যে ৬৯১টি সংস্কার প্রস্তাব ছিল, তার মধ্যে বিএনপি মাত্র ৭৩টিতে সম্মত হয়নি। ৩১ দফা দিয়ে দলটি আগেই সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছিল। কিন্তু মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব, যেগুলো নিয়ে এখনো আলোচনা চলছে, এগুলো অনেকটা দুধের মধ্যে এক ফোঁটা টকের মতো। তাদের সব চেষ্টা এই এক দুই ফোটার জন্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
এর মধ্যে দুটি মূল সংস্কার, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ এবং প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, তারা মেনে নেওয়ায় আমরা আশাবাদী হয়েছি। প্রতিটি ধারা নিয়ে তাদের আলোচনা, তাদের ‘সিরিয়াসনেস’ প্রকাশ করে। তারা বিভিন্ন আলোচনায় বলেছে যে তারা যা যা মানবে, সেটা তারা বাস্তবায়ন করবে। আগের মতো সব মেনে নিয়ে, কোনো কিছু না করার ধারা আমরা দেখতে চাই না।
একটি যুগান্তকারী নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বিএনপির সামনে সুযোগ এসেছে; এই সুযোগ কেবল নেতৃত্ব অর্জনের নয়, নেতৃত্বের সংজ্ঞা বদলে দেওয়ার। আর সেটি সম্ভব কেবল তখনই, যখন তারা সংস্কারকে বাধা নয়, বরং শক্তি হিসেবে দেখবে।
Co-authored with Asif Shahan and Subail bin Alam. First published in the Prothom Alo.
Further reading
Rethinking nationalism in the wake of Bangladesh’s uprising
Kazi ASM Nurul Huda, 27 Sep 2024
‘People see government as the enemy’: Bangladesh’s interim leader on the legacy of a toxic system
Professor Yunus interviewed, 12 June 2025
‘বাংলাদেশ বেকার সমাজের’ কেন্দ্রীয় কার্যালয় ছেলের বাসার ‘ড্রয়িংরুম’
মেহেদী হাসান, 25 June 2025
Banning the opposition is no way to revive Bangladesh’s democracy
The Economist, 26 June 2025
NCC is a bad idea. But there is a better option.
Zia Hassan, 28 June 2025
How long will victims of torture wait for justice?
Priya Ahsan Chowdhury, 1 July 2025
জুলাইয়ের পর প্রত্যেকে যার যার এজেন্ডায় চলে গেছে
নাহিদ ইসলাম interviewed, 1 July 2025
তারিক সিদ্দিক ও তাঁর স্ত্রীর বাগানবাড়ি, ফ্ল্যাট, জমিসহ বিপুল সম্পদের খোঁজ
নুরুল আমিন, 2 July 2025
Bangladesh needs pragmatic gradualism in nation-building
Rashed Al Mahmud Titumir, 3 July 2025
বিএনপির পাল্টা শক্তি হতে তৎপর ইসলামি দলগুলো
আব্দুল্লাহ আল জোবায়ের, 4 July 2025